কাঠখোট্টর মেয়ের সাদাসিধে ভালবাসা :
পলায়িত সাঁঝ,
যাবার বেলায় রেখে গিয়েছিল,
রক্তিম পায়ের ছাপ,
দুধর্ষ গোধুলী,
নোনা জলে ধুয়ে নিল,
লাল আলপনা,
টুকরো কথা ।
আর সবই ।
গোধুলীর এ সময়টা বেশ আনমনে হয় যায় লাবন্য। নিজেকে খুব অপরিচিত লাগে ওর, ভেতরের সত্ত্বাটা যেন হারিয়ে ফেলেছে সে । শত খুঁজে ও সেটার সন্ধান মিলাতে পারেনা। কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়, লাবন্যে কি তাহলে এতদিন লালিত সত্তা হারিয়ে ফেলেছে । বুঝতে পারছেনা, ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে ।
বাবা মার খুব আদরের সন্তান লাবন্য । দুই মেয়ের মধ্যে ছোটটি সে । লাবন্যের ছোট বেলাটা কেটেছে খুব দুরন্তপনা আনন্দ আর উচ্ছাসের মধ্য দিয়ে। তবে ও ছিল অনেকটা ব্যাতিক্রম, আর আট দশটা মেয়ের মত নয়। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সাথেই তার মেলা মেশা হত বেশি। ওর মাঝে মেয়ে সুলভ আচরণটা কম ছিল। সারাক্ষন দস্সিপনায় কাটতো লাবন্যের। ছেলেদের মত করে ক্রিকেট ফুটবল সবই খেলত, যা নব্বই দশকের মেয়েদের কাছ থেকে আশা করা যায় না।
তবে বাড়ির ছোট সন্তান হিসেবে যেমনটা স্বাধীনতা পাওয়ার দরকার ছিল, ঠিক ততটুকুই পেয়েছিল সে। বাবা,মা,বড় বোন কেউই তার কোন আব্দার কখনো অপূর্ন রাখেনি। জীবনে যা সে চেয়েছি তাই পেয়েছে।
এক রাতে তো ঘুম ভেঙ্গে আইসস্ক্রিম এর জন্য সে কি কান্নাকাটি, কি আর করার, নাছোড়বান্দা মেয়ে । পরে লাবন্যের বাবা এই রাত বিরাতে অনেক খুজে একটা দোকান থেকে তার জন্য আইসস্ক্রিম নিয়ে আসে! এরকম আরো কত শত টুকরো টুকরো আদর স্নেহে ঘেরা ছিল লাবন্যের জীবন, তা বলে শেষ করা যাবে না ।
দিন যেতে থাকে, আস্তে আস্তে লাবন্য বড় হয়, কিন্তু মানুষিক ভাবে সেই ছেলেপনাটা থেকেই যায়। কি জানি স্রষ্টিকর্তা হয়তো ভুল করে তাকে মেয়ে বানিয়ে ফেলেছিল। শৈশব,কৈশর পেরিয়ে লাবন্য এখন যুবতী। হয়তবা যৌবনটা ও এভাবেই পেরিয়ে যেত, যদি তৌফিক তার জীবনে না আসতো। অনেক ছেলে বন্ধু থাকা সত্যেও তাদেরকে সে ওভাবে দেখতো না, স্রেফ বন্ধুই ভাবত ।
আর তৌফিকের সাথে ওর পরিচয়টা ভার্চুয়াল জগত্ দিয়েই। তাদের বন্ধুত্বটা বেড়ে ওঠতে থাকে একটা চারা গাছের মত করে। তৌফিককে সে অন্য ছেলেদের মত ভাবত না, লাবন্য ওকে অনেক ভাবেই পরীক্ষা করেছিল। একবার তো লাবন্য অন্য এক নাম্বার থেকে তৌফিককে ফোন করে বসে, ওর উদ্দেশ্য ছিল তৌফিক মেয়েদের প্রতি কতটা দুর্বল সেটা পরীক্ষা করা।
-হ্যালো, কে বলছেন,
কাকে চাই ?
-নাম্বারের মালিক যেহেতু আপনি, সো চাই তো আপনাকেই। তা ভাল আছেন?
-আমাকে চান মানে, আপনি আমাকে চেনেন? একজন মেয়ে হয়ে ছেলেদের ফোনে ডিস্টার্ব করেন, লজ্জা করে না আপনার?
এরকম অপ্রত্যাশিত ব্যাবহার পেয়ে লাবন্যর একদম নাজেহাল অবস্থা ।
-জি ইয়ে মানে,
-এসব মেয়েদের না কখনো লজ্জা হবে না, ধ্যাত ।
বলে তৌফিক ফোনটা কেটে দিল। (লাবন্য তার গলার ভয়েস চেন্জ করে কথা বলে,যার জন্য তৌফিক তাকে চিনতে পারে নি)
যাইহোক লাবন্যে কোথায় মন খারাপ হবে, উল্টো সে খুশি হল । তৌফিকই তার স্বপ্নের রাজকুমার । যাকে নিয়ে সে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতে পারে, সংসারের করার চিন্তা করতে পারে । এরপর দুজন দুজনের আরো কাছে আসতে থাকে। তৌফিকের প্রতি লাবন্যের অগাধ বিশ্বাস ছিল। ওরা দেখা পর্যন্ত করেছিল একবার। নাহ তৌফিক দেখতে খারাপ না, আবার অতটা স্মার্ট বলা যায় না, সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ একজন, যেটাই লাবন্য চেয়েছিল।
ফোনে কথা বলা, চ্যাটিং, আর একটু একটু ভাল লাগা দিয়ে, সম্পর্কটা চর চর করে বেড়ে উঠতে থাকে । তবে তৌফিক যতই মেয়ে বিদ্দেষী হোক না কেন, লাবন্যের সাথে সে যথেষ্ট দুষ্টুমি করত । রাত জেগে জেগে কথা বলা, কথায় কথায় ব্যাবি বলা, জান্টুস,ময়না পাখি,টিয়া পাখি আরো কত কি । লুতুপুতু অবস্থা যাকে বলে । এসব কারনে লাবন্য ভেবেছিল তৌফিক ও হয়তবা তাকে ভালবাস। এবং উপর্যূপরি তৌফিকের প্রতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে, ওকে ছাড়া লাবন্যের এক মুহুর্ত চলাও সম্ভব না। লাবন্যের খাওয়া দাওয়া, পড়ালেখা সব খবরাখবর রাখতো তৌফিক। যথেষ্ট কেয়ার নিত ওর। তাছাড়া লাবন্য কোন দিন কোন ড্রেসটা পড়ে বের হবে সেটাও তৌফিককে জিঞ্জেস করতো । তাদের না বলা ভালবাসাটা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।
এদিকে লাবন্য অনেক বার আকার ইঙ্গিতে, নানান রকম উদাহরণ দিয়ে তৌফিক কে বুঝাতে চেয়েছে। কিন্তু তৌফিক এতটাই সহজ সরল ছিল যে লাবন্যকে ও বন্ধুর চেয়ে বেশী কিছু ভাবতে পারেনি। অথবা, বুঝতে পারলে বা কি, অনুভুতিগুলোর প্রত্তুত্বর করা সাহস তোফিকের হয় নি। কারন পরিবারের বড় ছেলে সে, বাবা মার প্রতি ওর যথেষ্ট দায়িত্ব কর্তব্যের কথা ভেবে, তৌফিক নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । আগের মত লাবন্যে মেসেজ কিংবা ফোনে তেমন রেসপন্স দেয় না, হয়তো বুঝতে পেরেছিল, এ ভালবাসার ভবিষত্ অন্ধকার। তাই একসময় লাবন্যকে এভয়েট করা শুরু করে ।
এদিকে লাবন্যের দিনকাটে বিষন্নতায়, মেজাজ আগের চেয়ে খিটখিটে হয়ে গেছে ওর। তার ভালবাসার মানুষটা তাকে এভাবে এভয়েট করে চলে, ভাবতেই চোখ দিয়ে দুফোটা পানি চলে আসে ওর চোখে। রাত জাগতে শুরু করে সে ।
ঘুম আজ চোখের পাতা থেকে
চলে গেছে বহু দুরে,
তোরই কথা এ মনে বাজে করুণ সুরে,
খুব রাতজাগার কারনে ইদানিং লাবন্যের চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। ওর মা বাবা ব্যাপারটা খেয়াল করে, কিন্তু একরোখা মেয়েকে কিচ্ছু বলতে পারে না। জীবন চলে যায় জীবনের নিয়মে ।
এখনো মাঝে মাঝে তৌফিক কে ফোন দেয় লাবন্য, "কেমন আছো ? কি করছো?" ব্যাস। তৌফিক শুধু উত্তর দিয়ে যায়, বেশী কিছু বলতে চায় না, যদি ফাদে পড়ে যায়, প্রেম নামক কঠিন সে ফাদে। লাবন্যের এ অবস্থার জন্য কে দায়ি, তা ঠিক আমি ও বুঝতে পারছি না । জানিনা এভাবে আর কত দিন চলবে, আর কতদিন লাবন্য তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার পেছন ছুটবে।
খুব রাগী, অনুভুতিহীন একটা মেয়ে, অথচ আজ সব কিছু কেমন পাল্টে গেল । আর ভাবতে পারছে না লাবন্য, নাহ নিজেকে এবার পাল্টে ফেলা দরকার । আর কারো জন্য কাঁদবে না সে , বলতে বলতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যায় ওর। নরম গাল বেয়ে ঝরতে থাকে কষ্টের তপ্ত অশ্রু ।
0 comments:
Post a Comment